উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার As You Like It নাটকে বলেছেন- “ Sweets are the uses of adversity ”. খুবই অর্থবহ এই সংলাপটি সেই সময়কার রাজা বাদশাদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিলো। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো সাধারণত রাজপ্রাসাদ কেন্দ্রিক ছিল। রাজ্য শাসন করার জন্য রাজা এবং জনগণের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত মূলত সেটিই তার নাটকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল। সংলাপটিতে বলা হয়েছে মন্দের মাঝেও ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে এবং সময়ের সাথে সেটা উন্মোচিত হয়। কাজেই মন্দ বলে কোনো কিছুকে সব সময় এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আমরা চোখ দিয়ে দেখি। কান দিয়ে শুনি। নাক দিয়ে গন্ধ অনুভব করি। পশুর মধ্যেও এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। কিন্তু মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে পশুর চোখের সামনে যা পড়ে তা দেখে বা শোনে। কিন্তু মানুষের দেখা ও শোনার মধ্যে পছন্দ বা অপছন্দের সীমারেখা থাকে। মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য এখানেই। জিহ্বা দিয়ে আমরা টক-মিষ্টি-ঝাল আস্বাদন করি। কথা বলি। মনের ভাব প্রকাশ করি। কিন্তু শুধু জিহ্বা থাকলেই মানুষ কথা বলতে পারে না। এজন্য বাকশক্তি প্রয়োজন। সঠিক কাজে সঠিকভাবে জবান ব্যবহার করা এবং অশ্লীল ও মন্দ থেকে জবানকে হেফাজত করা দরকার। মিথ্যা বলা, গিবত করা, অশ্লীল কথা বলা, ঝগড়া করা মস্ত বড় অন্যায়। অনেক মানুষ আছে মূক তারা কথা বলতে পারে না। কিন্তু মুখের ভাব-ভঙ্গিও অপরকে কষ্ট দিতে পারে। মুখের কথা বা বাচন-ভঙ্গির মাধ্যমে ভদ্রতা আর অভদ্রতার পার্থক্য ফুটে ওঠে। জিহ্বা একদিকে মানুষের বন্ধু অপরদিকে বড় শত্রæ। জিহ্বাকে মানব দেহের বডিগার্ড বলা হয়। কোনো বাড়ির গার্ড যদি অসুস্থ হয়ে যায় তখন বাড়ির নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। তেমনিভাবে কারও জিহ্বা অসংযত হওয়ার রোগে আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তি কাকে কী বলে এই নিরাপত্তাহীনতায় সবাই ভোগে।
বাংলাদেশে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে সব রাজনৈতিক দল,তাদের সমর্থক ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রেস নোট দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন। শুক্রবার হাইকমিশন তাদের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত প্রেস নোট প্রকাশ করে। প্রেস নোটে, পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের বিষয়টির দ্রæত তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা বলা হয়। এর আগে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) এক প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিফিংয়ে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স বলেন, গত কয়েক মাসে বিরোধীদের বেশ কয়েকটি সমাবেশে সহিংসতা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। পুলিশ সেখানে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও জলকামান ব্যবহার করে। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে এবং জনগণের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার চর্চার সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া তৃতীয় কোনো পক্ষ জনগণের সেই অধিকারকে দমন করতে চাইলে,তাদের অধিকার রক্ষায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
ব্রিফিংয়ের প্রেস নোটে বলা হয়, এসব ঘটনায় বিরোধী দলের সমর্থকদের পাশাপাশি কিছু পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। জ্যেষ্ঠ বিরোধী নেতাদেরও প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। এমনকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাদের বাড়িতে অভিযানও চালানো হয়। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, আমরা পুলিশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি,কেবল জরুরি প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রিতভাবে বল প্রয়োগ করা যেতে পারে। যদি করতেই হয়, বৈধতা, সংযমের ভিত্তিতে এবং যৌক্তিক কারণ সাপেক্ষে তা করতে হবে। অতিরিক্ত বল প্রয়োগের বিষয়টি অবশ্যই দ্রæত তদন্ত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের প্রচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। যা রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এবং ভিন্নমত প্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করে এবং সেটিকে উৎসাহিত করে।
নির্বাচনই কী গণতন্ত্রের শেষ কথা? নির্বাচন হলেই কী দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়? কায়েম হয় আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা? নিশ্চিত হয় বাক-ব্যক্তি ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা? নির্বাচন হলেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসাতে চান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। মঙ্গলবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি এই আহ্বান জানান। ডায়ালগ ছাড়া সংকটগুলো মীমাংসা হবে না। আর এ সংকটগুলো রাজপথে মীমাংসার বিষয় নয় বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে,রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে বসা উচিত; একসঙ্গে চা পান করা উচিত। সংলাপ নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেছেন এক নির্বাচন কমিশনার। গত ২৬ জুলাই নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আর কোনো সংলাপ নিয়ে ভাবছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। তিনি আরও বলেছেন, ‘সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিষয় আমাদের এখতিয়ারে নয়, রাজনীতির মাঠেই সমাধান হবে। আমরা তফসিল দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাব। যথাসময়ে নির্বাচনের তফসিল হয়ে যাবে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, আমরা যেমন চাপে থাকব, রাজনৈতিক দলগুলোও চাপে থাকবে। তবে নির্বাচন প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হলে আমাদের কাজ করতে সহজ হয়। আমরা আশা করব, সব দল নির্বাচনে আসুক।’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তার সহকর্মী কমিশনারের ভাবনা ও বক্তব্যের মধ্যে ব্যবধান অনেক। একজনের ভাবনা নিরপেক্ষ, অন্যজনের দল-ঘেঁষা।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যেও সংলাপের ইচ্ছা খুবই ক্ষীণ। যদিও সরকারি দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা সংলাপের ইচ্ছার কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপে বসতে বিএনপি রাজি থাকলে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তারা বারবার সংলাপের কথা বলে আসছেন। তবে সেই সংলাপ অবশ্যই হতে হবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে। এই একটিমাত্র ইস্যুতে সরকার সংলাপের আমন্ত্রণ জানালে তারা বিষয়টি ভেবে দেখবেন। মির্জা ফখরুলের মতে, এজেন্ডা ছাড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা আগেও সংলাপ করেছেন। কিন্তু তারা সংলাপে দেয়া কোনো প্রতিশ্রæতিই রাখেনি। তাই তাদের আর বিশ্বাস করা যায় না। এবার কোনো সংলাপ হলে সেটা অবশ্যই এজেন্ডার মধ্যে হতে হবে। আর এই মুহূর্তে সংলাপের একমাত্র এজেন্ডা হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। তাই সরকার যদি এই ইস্যুতে আলোচনা করতে চায় তাতে শুধু বিএনপি নয়, সব রাজনৈতিক দলই সম্মত হবে। তবে সংলাপের আগে সরকারকে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নিয়ে আলোচনায় না বসলে রাজপথেই এর সমাধান হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বাংলাদেশ সফর করেছেন। যাওয়ার সময় তিনি স্পষ্টই সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনিও বলেছেন সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না। তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টত, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চায়। ওই আহ্বানের জের ধরেই মঙ্গলবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সিইসি হয়তো-বা সংলাপের কথা বলেছেন।
সংলাপ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান, সিইসির ইচ্ছা এবং বিদেশিদের প্রত্যাশা ভিন্ন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংকট সমাধানে সিইসি এবং বিদেশিরা ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু প্রথম আগ্রহী হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। সংলাপ নিয়ে বিএনপির অবস্থান নতুন নয়। ২০১৩ সালের মে মাসে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকা সফর করেছিলেন। ওই সময় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেখানেও বিএনপির চাওয়া ছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। তারা বলেছিল নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিলেই আলোচনা হতে পারে। তারপরও বিএনপি আলোচনায় বসেছে। বিএনপির দাবি অনুসারে সেই আলোচনার কোনো কথাই রাখেনি আওয়ামী লীগ।
২০১৮-এর নির্বাচনের আগেও সংলাপ হয়েছে। ওই সংলাপের পর যে নির্বাচন হয়েছে তা বিশে^র কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিরোধী রাজনীতিকরা ওই ভোটের নাম দিয়েছেন রাতের ভোট। যেটা আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মুখেও পরে উঠে এসেছে। ফলে আলোচনা বা সংলাপ নিয়ে বিএনপির ভীতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। সরকার যদি কথা না রাখে এবং নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে,তবে সংলাপ কখনোই অর্থবহ হবে না। বিএনপির ভয় সেখানেই। তবে আলোচনা বা সংলাপ হবে কী নিয়ে? সংলাপ কি শুধু একটি নির্বাচন পরিচালনা করা নিয়ে হবে, না গোটা নির্বাচনব্যবস্থাকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা নিয়ে হবে। সেটা আগে নির্ধারণ জরুরি। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে, কোন আইনে অনুষ্ঠিত হবে। আর তা ঠিক করার উদ্দেশ্যেই সংলাপ হওয়া উচিত।
সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য,স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হওয়ার পরও তারা রাজনৈতিক সুস্থিরতার দেখা পেল না। গণতন্ত্রপ্রেমী এ দেশের মানুষ সুস্থির রাজনীতির প্রত্যাশায় থাকে। বিধিবাম,তেমন রাজনীতির দেখা মেলে না। রাজনৈতিক বিভেদ এমন জায়গায় উপনীত যে সাধারণ মানুষ এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রতিহিংসার রাজনীতি জেঁকে বসেছে সর্বত্র। সমাজও বিভক্ত হয়ে পড়েছে প্রধানত দুই শিবিরে।
এবারের সাধারণ নির্বাচনের প্রতি বিশ্ববাসীর চোখ থাকবে। নির্বাচন ঠিকমতো না হলে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে, দেশেও অশান্তি দূর হবে না। বিপরীতমুখী অবস্থান পরিত্যাগ করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দল দুটি যদি নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতায় উপনীত হতে পারে, তাহলে জাতি উপকৃত হবে।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply